আমাদের কার্যক্রমসমূহ
এই অধ্যায়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের চরাঞ্চলে বসবাসরত প্রায় দশ লক্ষ অতি দরিদ্র মহিলা, শিশু ও পুরুষদের জীবিকা, আয় এবং খাদ্য নিরাপত্তার উন্নয়নে সিএলপি যে কাজ করছে তার সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া হয়েছে।
দরিদ্রদের জন্য টেকসই জীবিকা এবং বাজার উন্নয়নে অগ্রগতি সাধন
যদিও অনেক মানুষ উন্নত জীবিকা অর্জনের সুযোগের আশায় নিজেদের আদি নিবাস ছেড়ে চরে এসে বসবাস করে, কিন্তু চরে বসবাসের জন্য তাদেরকে যথেষ্ট মূল্যও দিতে হয়। জীবিকা নির্বাহের জন্য চরের জনগোষ্ঠীকে মৌসুমি বন্যা, সেই সাথে নদী ভাঙ্গন এবং এর ফলে তাদের অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ের সাথে মানিয়ে নিতে হয়। অর্থাৎ, চরের জনগোষ্ঠীরা নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতে আক্রান্ত হয়ে থাকে যা তাদের খুব দ্রুতই পুনরায় অতি দরিদ্রতায় নিমজ্জিত করতে পারে।

নিজ গবাদি প্রাণির সাথে একজন সিএলপি সুবিধাভোগী।
চরের অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর টেকসই জীবিকা সৃষ্টির লক্ষ্যে সিএলপির সম্পদ হস্তান্তর প্রকল্পটি(এটিপি) পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রতিটি মূল অংশগ্রহণকারী পরিবারের মহিলা সদস্যকে ১৭,৫০০ টাকা (£১৪৬) মূল্যমানের আয় বর্ধনকারী সম্পদ প্রদান করা হয়। মূল অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের পছন্দ মত যেকোন সম্পদ নির্বাচন করতে পারলেও, অদিকাংশ পরিবার (প্রায় ৯৮%) গবাদি প্রাণি নির্বাচন করে।
চর এলাকায় গবাদি প্রাণি লালন পালন একটি উপযুক্ত সিদ্ধান্ত। এটি জীবিকা অর্জনের জন্য একটি পরিচিত মাধ্যম, কারণ অনেক পরিবারই আগে থেকে গবাদি প্রাণি পালন করে আসছে; গবাদি প্রাণি থেকে তারা থেকে মাংস, দুধ এবং বাছুরের মাধ্যমে ভাল আয় করতে পারে; চরের প্রেক্ষাপটেও তুলনামূলকভাবে এদের যত্ন করা সহজ; এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বন্যার সময় এদের নৌকায় তুলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়া যায়। সম্পদের সাথে, সিএলপি গবাদি প্রাণি ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ সহ অন্যান্য গবাদি প্রাণি স¤পদ সেবা, যেমন টিকা ও কৃত্রিম প্রজনন সেবা ইত্যাদির সমন্বিত প্যাকেজ সরবরাহ করে। সম্পদ হস্তান্তর প্রকল্পটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন ।

গবাদি প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ।
তথাপি, গবাদি প্রাণি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ দীর্ঘস্থায়ী জীবিকার প্রারম্ভ মাত্র। এছাড়াও চরের অধিবাসীরা দূর্বল বাজার ব্যবস্থা ও প্রায়শই প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় এবং অন্যান্য সেবা যেমন আর্থিক সুবিধা না থাকার সম্মুখীন হয়। সি এল পি এর বাজার ভিত্তিক উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে এই বাধা অতিক্রম করার জন্য কাজ করে। “দরিদ্রদের জন্য কার্যকর বাজার ব্যবস্থা (M4P)” পদ্ধতির মাধ্যমে, সিএলপি গবাদি প্রাণি, দুধ এবং গবাদি প্রাণির খাদ্যের ব্যবসায়ী দল গঠন করতে সাহায্য করে যার লক্ষ্য হল এর সদস্যদের উৎপাদন কৌশল উন্নত করার মাধ্যমে মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। এছাড়াও তারা বাজার ব্যবস্থার উৎপাদক ও অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে, যেমন: উপকরণ সরবরাহকারী (বীজ ও ফিড বিক্রেতা, সার ব্যবসায়ী, দুধ ও মাংস বিক্রেতা ইত্যাদি) ও এর ক্রেতা। এই ব্যবসায়ী দলগুলো চর ব্যবসায়ীক কেন্দ্র (সিবিসি) গুলোর মাধ্যমে
সহযোগীতা পায় যা বাজার ব্যবস্থায় বিদ্যমান বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। সিএলপি বেশ কিছু ক্ষুদ্র ঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানকে চর এলাকায় তাদের কাজ পরিচালনা করার জন্য কিংবা সেখানে তাদের সেবার পরিধি বাড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছে যেন এইসব ব্যবসায়ী দল এবং চর ব্যবসা কেন্দ্রের প্রতিনিধিগণ এর থেকে উপকৃত হতে পারে। সিএলপির বাজার সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
বন্যা ও নদী ভাঙ্গন থেকে চরবাসীকে রক্ষা
চরের অধিবাসীদের জন্য বন্যা ও নদী ভাঙ্গন খুবই নিয়মিত এবং বিপদজনক বিষয়। সিএলপির অনেক অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, নদী ভাঙ্গনের লক্ষণ দেখার মাত্র ১ ঘন্টার মধ্যেই তাদের ঘর-বাড়িসহ সমস্ত জিনিসপত্র এবং জীবিকা নির্বাহের সকল সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চরের লোকেদের চরম দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসার পথে এই ধরণের দূর্যোগের অত্যাবশকীয় একটি প্রভাব আছে। সেজন্যই সি এল পির পরিকাঠামো ইউনিট এই ধরণের দূর্যোগ সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে।
সিএলপি এর প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী পরিবারকে তাদের বসত ভিটা মাটি ফেলে বন্যায় প্লাবিত সর্বোচ্চ উচ্চতা হতে ৬০ সেঃমিঃ (২ ফুট) উঁচু করে বেঁধে দেয়। সিএলপির অংশগ্রহণকারী নয় এমন পরিবার সমূহকেও এই ভিটা বরাদ্দ দেয়া হয় যার মাধ্যমে বৃহত্তর চরবাসীরা এর সুবিধা ভোগ করে।
এই উঁচু ভিটাগুলোর উপর আক্ষরিক অর্থেই সিএলপির অনেক কাজের স্থায়ীত্ব নির্ভর করে। এই ভিটাগুলোও অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর জীবিকা, উন্নত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, পায়খানা, বসতভিটার বাগান এবং তাদের জীবনকে নিরাপত্তা দিতে সাহায্য করছে।
এবং এটি অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোকে এবং উঁচু ভিটায় বসবাসকারী অন্যান্য পরিবারগুলোকেই শুধু সুবিধা দিচ্ছে না। বন্যার সময় চরের অন্যান্য জনগোষ্ঠীও এই ভিটাগুলোতে নিজেদের অথবা তাদের গবাদি প্রাণী ও অন্যান্য আয় বৃদ্ধিকারী সম্পদকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বন্যা থেকে রক্ষা পায়। এইভাবে ভিটাগুলো বিপদের সময় চরের সকল অধিবাসীদের সাহায্য করছে- এবং মূল অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর সামাজিক অবস্থান উন্নয়নেও ভ’মিকা রাখছে। সি এল পির পরিকাঠামো ইউনিটের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন ।
পানি, পয়ঃনিস্কাশন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুযোগ বৃদ্ধি
একটি টেকসই জীবিকার জন্য সুস্বাস্থ্য অত্যাবশ্যক, বিশেষত চরবাসীদের জন্য যাদের কোন নিরাপদ আয়ের উৎস অথবা সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থার সুযোগ নেই। সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে নিরাপদ পানি সরবরাহের উৎস ও উন্নত পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সিএলপি এর অংশগ্রহণকারীদের টিউবওয়েল দিয়ে অথবা বিদ্যমান টিউবওয়েলের অবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সহায়তা করে। সিএলপির পানি কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন ।
সিএলপি এর অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোকে উন্নত পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা দিতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি করার মাধ্যমে সহযোগীতা করে। সিএলপির পয়ঃনিস্কাশন কাযৃক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন ।
উভয় কার্যক্রমই প্রশিক্ষণ ও সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারকারী কার্যক্রমসমূহের মাধ্যমে পূরণ হয়, যেমন: “খোলা যায়গায় মলত্যাগ মুক্ত গ্রাম” বিষয়ক অভিযান, যেখানে সিএলপি সমর্থিত গ্রাম উন্নয়ন কমিটি অগ্রণী ভ’মিকা পালন করে। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হল স্বাস্থ্যকর পায়খানা ছাড়া যেখানে সেখানে মলত্যাগের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এছাড়াও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ যেমন: সঠিক পদ্ধতিতে হাত ধোয়া ও কোন কোন সময় হাত ধোয়া জরুরি সেগুলো স¤পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
খাদ্য নিরাপত্তার উন্নয়ন ও উন্নত পুষ্টি ব্যবস্থার অগ্রগতি সাধন
খাদ্য নিরাপত্তা বিদ্যমান থাকে যখন “সকল মানুষ, সব সময়ে, একটি সুস্থ ও সক্রিয় জীবন যাপন অব্যাহত রাখার জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের সুবিধা পায়”। খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জটিল একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু একে তিনটি স্তম্ভে ভাগ করা যায়”
- খাদ্যের প্রাপ্যতা: একই রকমভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের প্রাপ্যতা থাকতে হবে;
- খাদ্য লাভের সুবিধা: পরিবারের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য নিয়মিত গ্রহণের সক্ষমতা থাকতে হবে; এবং
- প্রাপ্ত খাদ্যের সদ্ব্যবহার: মানুষের দেহে গ্রহণকৃত খাদ্যের ইতিবাচক প্রভাব থাকতে হবে।
সিএলপি এর বসত বাড়িতে বাগান প্রকল্প, সেই সাথে হাঁস-মুরগী পালন প্রকল্পের মাধ্যমে খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, স¤পদ হস্তান্তর প্রকল্পের এর মাধ্যমে অনেক পরিবারে দুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়েছে। বিভিন্ন কারনে মূল অংশগ্রহণকারীদের খাদ্য লাভের সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিএলপির দেয়া সম্পদের মাধ্যমে পরিবারগুলো তাদের জীবিকার বহুমুখীকরণ করতে পারে যেমন-জমি ক্রয় ও ইজারা নেয়া যা পরবর্তীতে তাদের আয় বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। সিএলপির স্বাস্থ্য, পানি, পয়ঃনিস্কাশন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে খাদ্যের সদ্ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। সিএলপির অংশগ্রহণকারীরা কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় কম অসুখে ভোগে; তাদের পায়খানা ও অন্যান্য পানির উৎসের কাছে ছাই ও সাবান রাখা থাকে ; এবং তারা হাত ধোয়া কার্যক্রমে অনেক বেশি তৎপর; এই সূচকগুলো সিএলপির অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে খাদ্যের সদ্ব্যবহারের উন্নয়নকেই নিশ্চিত করে।
২০১৩ সালে, সিএলপি সরাসরি পুষ্টি কার্যক্রম প্রকল্প গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে পুষ্টি বিষয়ে জনপ্রতি পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীকে আয়রণ ও ফলিক এসিড ট্যাবলেট এবং মাল্টি-নিউট্রিয়েন্ট পাউডার বিতরণ করা হয়। সিএলপির পুষ্টি কাযৃক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন ।
নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়নকে সমর্থন
সি এল পির সকল মূল অংশগ্রহণকারী সদস্যই মহিলা। অংশগ্রহণকারী হিসেবে নারীদের বাছাই বাস্তবিক কারণেই করা হয়েছে (অনেক পরিবারেই প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ অথবা স্বামী ভাসমান শ্র্রমিক, এবং এই কারণে তারা বছরের অনেকটা সময়ই চরে উপস্থিত থাকে না), সেই সাথে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়নের অগ্রগতির দিকেও লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
সি এল পি সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের দল, আলোচনা সভা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সামাজিক উন্নয়ন দলের মাধ্যমে স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ যেমন: বাল্যবিবাহ, যৌতুক এবং পারিবারিক সহিংসতার মত বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয়। সিএলপি সমর্থিত গ্রাম উন্নয়ন কমিটি, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য “খোলা যায়গায় মলত্যাগ মুক্ত গ্রাম” বিষয়ক অভিযান; এবং কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গঠিত দল তাদের বয়ঃসন্ধিকাল, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি, প্রজনন স্বাস্থ্য ও বিবাহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দেয়।
সিএলপি দম্পতি, পুরুষদের ও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সমাজ উন্নয়নমূলক বিষয়ে আলোচনা করে, এবং প্রথাগত কিছু চর্চা যেমন যৌতুক ও বাল্যবিবাহের মাধ্যমে যে ক্ষতি সাধিত হয় সে বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও চরের মহিলাদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির মাধ্যমে সি এল পি নারীর ক্ষমতায়ন নির্ধারণের জন্য একটি পদ্ধতি ও স্কোরকার্ড তৈরি করেছে। সি এল পি কিভাবে নারীর ক্ষমতায়ন পরিমাপ করে এবং এর ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন এবং সি এল পির সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
8,022 total views, 5 views today